বিজয় দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা
১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। একাত্তরের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন আজ।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি রাষ্ট্র। পেয়েছিল একটি স্বাধীন দেশ। পেয়েছিলো লাল-সবুজের পতাকা। আজকের দিনটি তাই গৌরবের, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দিন আজ। আজ বিজয়ের বার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি সেইসব বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে লাল-সবুজের পতাকা।
শহীদদের স্মরণ করতে তাই আজ আমরা গিয়েছিলাম মহান স্মৃতিসৌধে।
চারিদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি, আর সম্মুখভাগে লাল ইট দিয়ে আচ্ছাদিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের উচু উচু মিনারগুলো দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, স্বাধীনতা, সংগ্রাম আর গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
সাভারের এই জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের দশটি গণকবর রয়েছে। এ ছাড়াও এর চতুর্দিকে রয়েছে বিস্তৃত এলাকা নিয়ে সবুজ বৃক্ষরাজি ।
১৫০ ফুট উচ্চতার সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে ক্রমশঃ বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে।
এটি শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রতি বছরের স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে এ স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বহু দূর-দূরান্ত থেকে এদিন এখানে এসেছিলন হাজারো দেশপ্রেমিক জনতা। তাঁদের সাঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি দেশের প্রতি, শহীদদের প্রতি তাঁদের আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কথা। এদিন সবার মুখে ছিলো বিজয়ের হাসি আর সবার চোখেমুখে ছিলো এই দেশকে ভালোবেসে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয়।
তবে এদিন এই স্মৃতিসৌধে একটি বিষয় আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, অনেকেই না জেনে এখানকার গণকবরগুলোর উপর হাটাচলা করছেন, কেউবা ছবি তুলছেন। এ বিষয়ে অনেকেই তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন আমাদের। আমরাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে করে এই কবরগুলোর সামনে নোটিসবোর্ড দিয়ে সর্বসাধারণকে গণকবরের উপরে না উঠার জন্য অনুরোধ করা হয়।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা লাভ করেছি স্বাধীনতা। আমাদের স্বপ্ন ছিল অনেক, কিন্তু পূরণ হয়েছে সামান্যই।স্বাধীনতার ৪৬ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জন থাকলেও প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি এখনো। এখনো দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এখনো বহু মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকার। এসব ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। এছাড়া আমাদের অগ্রগতির পথে বড় যে সমস্যা, তা হলো দুর্নীতি। প্রশ্ন ফাঁস থেকে শুরু করে শিক্ষার নামে কোচিং বাণিজ্য, সাধারণ মানুষের টাকা ভক্ষণ, ঘুষ, অপহরণ, ছিনতাই, অশ্লীলতা, মাদকদ্রব্যের আগ্রাসন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মিথ্যা মামলা, গুম, খুন ইত্যাদি আমাদের স্বাধীনতা আর বিজয়ের ইতিহাসকে ম্লান করে দিচ্ছে অনেকাংশে।
আমরা চাই নকলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠিত হোক ঘুষ ছাড়াই চাকরির অধিকার, আমাদের দেশ হোক দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত। আমরা চাই না বাসস্থানের অভাবে কেউ রাত কাটাক রাস্তার ধারে, চাইনা ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য খুজুক আর কোনো শিশু। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলো বীর শহীদেরা, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।